সৈয়দ পুরের মাঠির ঘটনা
১৯৮০ সালের আমার
মুরশীদ আল্লামা ফুলতলী (রহঃ) সৈয়দ পুরের জমিনে সুন্নীয়ত প্রতিষ্টার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন, ওয়াহাবীদের হাতে। কিন্তু তারা স্তব্ধ করতে পারেনি সুন্নীয়তের যাত্রা বরং পৃথিবীর আনাচে কানাচে আর সহজে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন এ মহান বানী।
আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি
সেই ১৯৮০ সালের ৫ই মার্চ এর ঘটনা।রক্তাক্ত সৈয়দপুরের মাটির ঘটনা।
আল্লামা ফুলতলি ছাহেব (রহ:) এর জীবনের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা কারী গিয়াস উদ্দিন সাহেব বললেন-১৯৮০ ইংরেজীর ৫ই মার্চ, ১৩৮৬ বাংলা ২১ ফাল্গুন মঙ্গলবার রাত পৌনে দশটার সময় জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুর গ্রামের দক্ষিণের হাওরে হবিবপুর মাদ্রাসার জলসা হতে ফুলতলী ছাহেব (রহ:) শাহারপাড়া নওয়াগাও জলসায় যেতে রওনা দেন। হঠাৎ একদল লোক
লাঠিসোটা হাতে(আনুমানিক ৩০০/৪০০ নরপশু) হযরত ছাহেব কিবলার উপর হামলা চালায়।
ফুলতলী ছাহেব (রহ:) কে শাহারপুর নওয়াগাও জলসায় নিতে উক্ত গ্রামের মসজিদের ইমাম হবিবপুর সভায় আসেন। তার বাড়ী কানাইরঘাট। বাদ মাগরিব ছাহেব কিবলাহ (রহ:) মাহফিলের সকলকে তওবা বয়েইওত করিয়ে যিকিরের তলকিন দিয়ে মাদ্রাসা গৃহে যান। এ সময় ছাহেব
কিবলাহর (রহ:) খিদমতে উল্লেখিত ইমাম
হাজির হয়ে কদম্বুসি করে শাহারপাড়া যাওয়ার প্রস্তাব দেন।ছাহেব বলেন,আমার যাওয়া সম্ভব হবে না। অন্য আলিম নিয়ে যাও।তখন ছাহেব কিবলার (রহ:) কদমে ধরে উক্ত ইমাম কান্না শুরু করে। ইমামের কাকুতি-মিনতির কারণে তিনি রাজী হয়ে যান। তিনি অযু করেন এবং পালকিতে চড়ে রওয়ানা দেন। আমরা তখন ছাহেব কিবলার (রহ:) সফরসঙ্গী। যাত্রার শুরুতে ৭০/৮০জন লোক ছিলেন।পথিমধ্যে ভবেরবাজার
নামক স্থান্টি অতিক্রম করে ছাহেব কিবলা (রহ:) পালকি থেকে ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন পড়তে থাকেন। তার পড়া শুনে জিজ্ঞাসা করি ছাব কি হয়েছে?
বলেন,পানি দাও। তখন চেহারা মুবারকের দিকে দৃষ্টি দিয়া দেখি,পবিত্র চেহারা আগুনের মত লাল হয়ে গেছে। সেদিকে তাকানোর কোন শক্তি নাই।এদিকে পানিরও কোন ব্যবস্থা নেই।সেক্রেটারি মো: আতাউর রহমান ও আমি পালকিতে ধরে হাটতে থাকি। ছাহেব কিবলাহ (রহ:) চক্ষু বন্ধ করে বসে থাকেন। এভাবে নদীর পাড়ে পৌছালাম। তখন নদী পাড় হওয়ার জন্য ডুবন্ত একটি নৌকা তোলা হয়।
ছাহেব কিবলার (রহ:) ব্যাগ কয়টির একটি ব্যাগ
বহনকারী ইমাম এ সময় কিতাবের ব্যাগটি নিয়ে বাশের পুল পাড়ি দিয়ে নদীর পূর্বপাড়ে যায়। আমিও তার পেছনে যেতে থাকি। রাস্তা পাড়ি দিয়ে সে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে সৈয়দপুর গ্রামের দক্ষিণে একটি স্কুলে প্রবেশ করে। দেখলাম সেখানে অনেক লোক অপেক্ষমান। ইমাম স্কুল ঘরে ঢোকা মাত্র সবাই ময়দানে বের হয়ে আসে। ব্যাপারটি আচ করতে পেরে
আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি ছাহেব কিবলাহকে
নিয়ে ততক্ষনে অন্যরা নদী পাড়ীদিয়ে পূর্বপাড়ে পৌছে গেছেন। এদিকে চতুর্দিক থেকে আওয়াজ উঠছে ফুলতলীকে শেষ কর।
এদের বেশির ভাগ লোকের পড়নে লম্বা কাটা চিল্লা পাঞ্জাবী। মৌলভির লোক এবং বহু গুন্ডা লোক। এরা আমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে এবং জিজ্ঞাসা করে ফুলতলী কোথায়? এমন বিপদের সময় আল্লাহর কি অপার মহিমা বিশ্বনাথের চানপুর গ্রামের ছাত্র ক্বারী সুরুজ আলী শাহারপাড়ার দিকে দৌড়ে যায়। পরে জানতে পারি সেখানে গিয়ে সে সংবাদ পৌছায়। সে গিয়ে সরাসরি স্টেজে উঠে সবাইকে মাইকে সংবাদ প্রচার করে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এদিকে নৌকা থেকে নেমে ছাহেব কিবলাহ (রহ:) পালকিতে আর না চড়ে স্বভাব সুলভ নিয়মে নদীর পাড় ধরে হেটে চলেন। বিপদ বুঝে আমরা কজন ছাহেব কিবলাহ (রহ:) কে কড়া বেষটন করে রাখি। এখান থেকে শাহারপাড়া বেশি দূর নয়।
মাহফিলের মাইকে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে চারজন মৌলভী এসে বলে,ফুলতলী ছাহেব কোথায়? ছাহেব কিবলাহ (রহ:) তাদেরকে সালাম দেন।
তারা সালামের জবাব দিলো না। তখন
ছাহেব কিবলাহ (রহ:) বললেন এ কী অবস্থা,তোমাদের উদ্দেশ্য কী? আমার সাথে কোন থাকলে বল,নতুবা তোমরা যেভাবে এসেছ,যুলুম করলে জমিন তা বরদাস্ত করবে না। সাথে সাথে তারা আমাদের বেষ্ঠনি ছিন্ন করে ভেতরে ঢুকে যায় এবং ছাহেব কিবলাহর গলার মাফলার ধরে টান দেয়। এতে তার মাথা মুবারক সামনের দিকে ঝুকে যায়। আমি ও সেক্রেটারি আতাউর রহমান ছাবকে জড়িয়ে ধরি এবং তার শির মুবারকের উপর দিয়ে মাফলার গলা হতে খুলে নেই। তাতে টুপি পড়ে যায় এবং নিজ হাতে তিনি টুপি উঠিয়ে নেন।
তখন তারা চিৎকার দিয়ে উঠে ফুলতলী এখানে। দেখতে না দেখতে দুশ্মনের দল আমাদেরকে লাঠিসোঠা দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে এবং বলতে থাকে-"আর মিলাদ পড়বায়নি,দোয়াল্লিন পড়বায়নি,বেদাতির দল"। এ অবস্থায় আলতাফুর রহমান,আমি নালায়েক,ছাত্র মো: আব্দুল মালিক,ক্বারি মো: গোলাম রাব্বানী,হাফিজ মো: সিরাজ উদ্দিন ওরফে চেরাগ মিয়া এবং মো: আলী রবেশ,ছাহেব কিবলাহর (রহ:) উপর পড়ে
থাকি। ছাব তখন ইয়া রাসূলআল্লাহ বলে বুলন্দ আওয়াজে ডাকতে থাকি। ওহাবি মুল্লারা চার জনকে মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। আমি অধম ও আলতাফুর রহমান ছাবের উপর পড়ে থাকি। তখন আমাকে তারা সরিয়ে নিয়ে যায়।
এই সময় ছাহেব কিবলাহর বদনে আল্লাহর রাসূলের দুশমনেরা আঘাত করতে থাকে। এর আগে কোন আঘাত করতে পারে নি।
তখন ছাহেব কিবলাহ (রহ:) আল্লাহু আকবার
বলে উঠেন।পাশে চারজন মাটিতে পড়ে
আছেন,সাহায্য করার ক্ষমতা কারো
নেই।
কোনমতে যালিমদের হাত থেকে ছুটে এসে আবার ছাহেব কিবলাহর উপর ঝাপিয়ে পড়ি। তখন প্রানের ধন,নয়নের মণি,মুরশিদে বরহক্ব তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পানি খুজেন।
দুশমনেরা অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে।নদীর পারে ঘটনা,নদীতে পানি আছে,তবুও এক কাতরা পানি দেয়নি এরা কারবালার মত বরং বলে ইয়া নবি কোথায়?
ইয়া নবি বলে ডাকার সাধ আজ মিটিয়ে দেব। আজ চিরজীবনের লাগি দুনিয়া থাকি বিদায়। আমরা ইয়া রাসুলুল্লাহ,ইয়া রাসূলুল্লাহ বলে বেপানা হয়ে ডাকতে থাকি। দুশমনেরা আঘাতের উপর আঘাত করতে থাকে।
আল্লাহর কুদরতে তবুও আমরা হুশহারা হইনি। হুজুর পাক (সা) কে কায়মনোবাক্যে ডাকতে থাকি। ছাহেব বলেন,বাবারা!
সবর কর,যদি আমরা পানির পিপাসায় মারা যাই তা হলে হাশরের ময়দানে দরবারে আকদ্দসে আশ্রয় পাব। রক্তে রঙিন অবস্থায় পড়ে আছি যালিমদের যুলুম চলতেছে।
ছাহেব কিবলাহ (রহ:) হঠাৎ দাড়িয়ে গেলেন আর বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার বাচ্চাদেরকে নিয়ে নিরাশ্রয় ময়দানে আপনার মুহব্বতে জান কুরবান দিতাছি এবং বললেন,বাবারা !তোমরা কোন চিন্তা কর না। দয়াল নবী রাহমাতুল্লীল আলামিন আমাদের দেখছেন। ছাহেব কিবলাহ (রহ:) আবার বললেন,ইয়া রাসূলুল্লাহ আমার বাচ্চাদেরকে নিয়ে বেপানায় আছি। তখন চেয়ে দেখি চাদরের আকৃতিতে সবুজ রঙের এক আবর এসে আমাদের উপর আবরন দান করেছে। এ আবরের আলোর ভেতরে গোলাকার অন্য এক আলোকপিন্ড রয়েছে। উজ্জ্বল আলোর মধ্যখানে দৃষ্টিগোচর হল নূরে মুজাসসাম মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) এর চেহারা মুবারক। অন্তরে পরম প্রশান্তি পেলাম। তখন ছাহেব কিবলাহ (রহ:) বললেন,চিন্তা করো না,তারা আর আমাদের মারতে পারবে না। আল্লাহর হাবিব আমাদের দেখছেন। পরে ওহাবি যালিমরা ছাহেব কিবলাহর উপর হাত সরিয়ে আমাকে মাটিতে ফেলে দেয় ও আমার দুপা টেনে নিয়ে দূরে নিয়ে যায় এবং যতচ্ছভাবে মারতে থাকে ও বলে "মিলাদ ও দোয়াল্লিন"পড়ার কাজ আজ্ শেষ। যত সময় হুশ থাকে বলতে থাকি পড়বো এবং ইয়া রাসুলউল্লাহ বলতে থাকি।
তখন আমার পিটেএ উপর দুই ব্যক্তি উঠে আঘাত করতে থাকে ও বলে-আজ ইয়া নবি সালামু বলার সাধ মিটিয়ে দিতাম,আমি প্রায় বেহুশ হালতে পড়তে থাকি।
পানির পিপাসায় কলজে ফেটে যাচ্ছে,তখন বলি তোমরা তো মানুষ আমাকে এক কাতরা পানি দাও। তাতে এরা আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। এ অবস্থায় যালিমদের একজন বলে"চল এর কাম শেষ,এখন ফুলতলিরে বস্তাবন্দি করে মাটির নিচে চাপা দিতে হবে। তখন হাত দিয়ে একজনের পা ধরে বলি-মিলাদ পড়ার কারনে তোমার মনে কোন দু:খ তাখলে তোমরা তাকে প্রানে মারবে না,আমাকে মেরে ফেল তার বদলে।
তখন আমাকে পায়ে ধরে টেনে নিয়ে খালের কাদার মধ্যে ফেলে দেয় ও মুখে মাটি দিয়ে মুখ বন্ধ করে কাদার মধ্যে কোমর পযন্ত গেড়ে ফেলে আমার আর হুশ থাকে না।
পরে জানতে পারি,ইতিমধ্যে শাহারপাড়ার লোকজন এসে ছাহেব কিবলাহ ও আহতদের নিয়ে শাহারপাড়ায় ফিরে যান এবং ওহাবী দুশমনেরা আমাদেরকে মেরে ফেলেছে ভেবে পালিয়ে যায়। হযরত ছাহেব কিবলাহ (রহ:) কে শাহারপাড়া নেয়ার পর মুরশিদে জামান বলেন,"আমার গিয়াস উদ্দিন কোথায়? তখন আমার তালাশে লোক পাঠালেন। তারা এসে তালাশ করে আমাকে পান না। ইত্যবসরে সাহারপাড়া মাহফিলের তিন চার বাড়ি পশ্চিমে এক বাড়ির মহিলা কাদার মধ্যে গাড়া একটি লাশ দেখে চিৎকার করে উঠে। সেখান থেকে আমাকে নেয়ার পর ছাহেব কিবলাহর আদেশে সেলাই দেয়া হয় এবং ডাক্তার মুখ হতে মাটি বের করে ফেলেন। পরদিন সকাল ৮টায় আমার হুশ ফিরে আসে।লোকজন আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে উঠেন। আমি বললাম ছাব কোথায়?
উপস্থিত সকলে বলেন,আল্লাহ ছাহেব কিবলাহ (রহ:) কে সালামতে রেখেছেন। তার শির মুবারকে মারাত্মক যখম ছিল এবং অনবরত খুন বের হওয়া সত্তে ও তিনি সালামতে এসে মুরিদানকে শান্তি দিচ্ছেন এবং তওবা বয়েত শেষে দুয়া করে সকলকে বললেন,আমরা প্রতিশোধ চাই না,কোন বিচারও চাই না। হাবিবে খোদার মুহব্বত আমার খুন ওয়াকফ করে দিলাম।আমার খুনের সদকাতে আল্লাহ যেন সহিহ ইসলাম জিন্দা করেন ও হাশরের ময়দানে রাহমাতুল্লীল আলামীনের লেওয়ায়ে হামদের নিচে স্থান দেন এবং তোমরা কোন প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করবে না।
ছাহেব কিবলাহর শির মুবারকে ১৯টি সেলাই
দেয়া হয়েছিল। পরে আমাদেরকে সিলেট সরকারী হাসপাতাল এ ভর্তি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা হাবিবে পাকের উসিলায় ছাহেব কিবলাহ (র:) ও তার রুহানি আওলাদগনকে সালামতে জিন্দা রেখেছেন এবং নূরে মুজাসসাম মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) এর শানে রিসালতের আওয়াজ তোলার ও পবিত্র মিলাদ মাহফিল জারি রাখার তাওফিক দান করেছেন।
আমাদের প্রাণ প্রিয় মুর্শিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজকে ইয়া নবী সালামুআলাইকা বলতে পারি, নবীজীর শানে দাঁড়িয়ে ক্বিয়াম করতে পারি, আল্লাহপাক যেন আমাদের প্রাণ প্রিয় মুর্শিদকে জান্নাতের আলা দরজা দান করেন, দরজা লক্ষ কোটি গুন বুলন্দ করেন-আমিন।
0 Comments